মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ অপরাহ্ন
প্রকল্পের আওতায় খাল খনন, কালভার্ট নির্মাণ, পুকুর ও জলাশয় তৈরি, গাড়ি ভাড়া, কম্পিউটারসহ নানা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কাজে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্টরা আবেদন জানিয়েছেন।সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষি খাতের উন্নয়নসহ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত বছর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রায় সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাসহ কক্সবাজার অঞ্চলে নানা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এসব কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর মাত্র দুই মাসে এই প্রকল্পের আওতায় অন্তত ৫শ’ টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ছুটির দিনেও ইস্যু করা হয়েছে ওয়ার্ক অর্ডার। অস্থায়ী লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএডিসি’র ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রকল্পের তথ্যাবলী থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার কৃষি উন্নয়ন ও ভূ-উপরিস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার প্রকল্পের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি খাল পুনঃখনন, অনাবাসিক ভবন (ইউনিট অফিস), খালের পাড়ে আউটলেট স্থাপন, জলাধার/পুকুর খনন (পাড় বাঁধাই ও বৃক্ষরোপণ, ডাগওয়েল নির্মাণ (সৌরশক্তি চালিত পাম্পসহ), ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, আর্টেশিয়ান নলকূপ খনন ও কমিশনিং, রেগুলেটর বা সাবমার্জড ওয়্যারসহ বড় আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, ক্রসড্যাম কিংবা কালভার্টসহ মধ্যম আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, ফুটব্রিজ কিংবা ক্যাটলক্রসিংসহ ছোট আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সূত্র জানিয়েছে, এসব খাল খননের নামে দুই পাড়ের ঘাষ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় সামান্য মাটি কাটা হলেও তা ধারেকাছেই ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে যা আবার খালে গিয়ে পড়েছে। প্রকল্পের আওতায় কালভার্ট নির্মাণেও অনিয়ম হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় ৪০ দিনের কম সময়ে নজিরবিহীনভাবে ৪৬১টি টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারের উপদেষ্টা বরাবরে প্রেরিত এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এসব টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।প্রকল্পের ভূমি জরিপের সবগুলো কাজ পেয়েছে ডিজিটাল সার্ভে কনসালটেন্সি ও ল্যান্ড সার্ভে টিম নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সম্পর্কে মা ও মেয়ে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। মেসার্স বিপ্লব ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪ বছরের জন্য ৪ কোটি ৮১ টাকা ব্যয়ে তিনটি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রকল্প পরিচালক নিজে বলেও বিএডিসি অফিসে প্রচারণা রয়েছে।অভিযোগ রয়েছে, নিজের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে পিপিআর নীতিমালা লঙ্ঘন করে টেন্ডার বাছাই কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছেন প্রকল্প পরিচালক নিজেই। অন্তত ১০টি টেন্ডার ওটিএম পদ্ধতিতে কল করেও পরে তা স্থগিত করা হয়। পরে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে মোটা অংকের কমিশন গ্রহণের বিনিময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে জাল অভিজ্ঞতা সনদের বিপরীতে ‘এন. মোহাম্মদ প্লাস্টিক ইন্ডাষ্ট্রীজ লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানকে ১২টি টেন্ডারে ১১ কোটি টাকার uPVC পাইপ সরবরাহের কাজ পাইয়ে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও, পছন্দের ঠিকাদারদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে রীতি ভঙ্গ করা, ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করাসহ বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।
পুরো প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ বিএডিসি’র সদর দফতরেও অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের বড় ভাই বিএডিসি’র শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়ায় সব অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার হরিলুট চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিষয়গুলো নিয়ে অভিযোগ করা হলেও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, পিডি নুরুল ইসলাম ২০২১ সালে মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। তবে মাত্র ৪ মাসের মাথায় একই বছরের ২০ জুন দুর্নীতির দায়ে অপসারিত হন। ওই সময় তার বিরুদ্ধে কাজ দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ ও প্রকল্প পরিচালক নিজেই প্রকল্পে গাড়ি সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর তাকে হবিগঞ্জ অঞ্চলে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তবে বদলি করা হলে কি হবে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে কয়লা শতবার পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুইলেও ময়লা যায় না ঠিক তেমনি যেখানেই বদলি করা হয়েছে সেখানেই অপরাধ দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়েছেন নুরুল ইসলাম। হবিগঞ্জ অফিস ভবনের কাজ চলমান ছিল,সেখানে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে নিজের ব্যক্তিগত কোষাঘারকে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের নজরে এলে পুরো কাজটি খতিয়ে দেখা হয়।হবিগঞ্জ অফিস ভবনের নির্মাণ কাজের অনিয়ম নিয়ে বিএডিসি অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত করে। তদন্তে দেখা যায়, ভবন নির্মাণে প্রায় ৩৬টি খাতে অনিয়ম করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পুরো ভবনের বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ শেষ হতে না হতেই হাত লাগালে প্লাস্টার খসে পড়ছে। বাইরে লাগানো সিরামিক খসে পড়ছে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নামকাওয়াস্তে রং লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া নিম্নমানের ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে ভবনে। অনেক কাজ সমাপ্ত না করেই খাতা-কলমে সমাপ্ত দেখানো হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে।
গত বছরের ১০ মে ওই তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়। তবে অভিযোগ ওঠার পর পরই নুরুল ইসলামকে হবিগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বদলি করে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ।দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএডিসি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নুরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে বক্তব্য চেয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।